খেলা কেন দরকারিঃ আপনার ছোটবেলার পছদের খেলনাটার কথা মনে পড়ে? ঐটা কি প্লাস্টিকের বারবি ডল, টেডি বিয়ার নাকি ছোট একটা ফুটবল কিংবা গাড়ি ছিল সেটা এটা ভাবার বিষয় না। এটা আপনার পছন্দের এবং খুব প্রিয় খেলনা ছিল। পৃথিবীর সবকিছু থেকে ঐ খেলনাটাকে বেশি ভালবাসতেন। সারাটা বেলা কেটে যেত ঐ প্রিয় বন্ধুর সাথেই, তাই না?
আপনি হয়তো এটা জানেন না যে, প্রিয় ঐ খেলনাটি কিভাবে আপনার নৈতিক ও মূল্যবোধের শিক্ষাকে প্রভাবিত করেছে। নতুন নতুন ধারণা শিখতে, বিষয় রপ্ত করতে সাহায্য করেছে এবং বহু বছর পর সেই শিক্ষার ছাপ আপনার জীবনে কোন না কোন ভাবেই রয়ে গেছে।
আমাদের জনপ্রিয় ক্রিকেট অল-রাউন্ডার, সাকিব আল হাসান এর কথাই ধরুণ। তাঁর ছোট বেলায় প্রিয় খেলা ছিল ফুটবল। ফুটবল নিয়ে সারাদিন কাটতো বলেই খেলার প্রতি তাঁর একটা আগ্রহ তৈরী হয়েছিল। খেলাধুলা তাঁর অসম্ভব ভাল লাগতো। আর সেই ভালোলাগাই পরবর্তী জীবনে তাঁকে বিশ্বের নাম্বার ওয়ান ক্রিকেট অলরাউন্ডার হিসেবে পরিচিত করে তুলেছে। এক সময়ের ভাললাগা কেমন করে যেন নেশা-পেশা হিসেবে জীবনে জড়িয়ে গেল।
বিশেষজ্ঞগণের মতে, বাচ্চারা একটিভিটি তথা খেলাধুলার মাধ্যমেই শিখে। তখন খেলনাই হয় তার জীবনের প্রথম বন্ধু এবং একমাত্র সঙ্গী যাকে কেন্দ্র করেই তার পৃথিবী আবিস্কার করার সূচনা হয়। তাদের গ্রোথ, লার্নিং ইত্যাদি বিষয়গুলোও ক্রমান্বয়ে খেলার মাধ্যমেই অর্জন এবং প্রাত্যহিক জীবনে প্রয়োগ হয়ে থাকে। তাদের আবেগ, অনুভূতির প্রকাশও হয় খেলাকে কেন্দ্র করেই। শিশুদের মস্তিস্ক উন্নয়নে বিজ্ঞান দেখেছে খেলার ভূমিকা অনেক এবং এটা তাদের ব্যক্তিত্ব বিকাশেও সহায়ক।
নানান ধরণের খেলার মাধ্যমে বাচ্চারা সারাদিন ফিজিক্যাল এক্টিভিটিতে ব্যস্ত থাকে। হতে পারে সেটা রং পেন্সিল দিয়ে দেয়াল রং করা, ডলের জামা খুলে কেটে ফেলা, বা গাড়ির রিমোট নিয়ে সারা রুম দৌড়ানো। মজার ব্যাপার হচ্ছে বাচ্চারা খেলার সময় তাদের সহজাত বুদ্ধি ব্যবহার করে। ওয়াকার, টয় সাইকেল, টয় কার কোনটায় কিভাবে চড়তে হবে, কিভাবে চালাতে হবে তা তারা সচেতনভাবেই মনে রাখতে পারে। এবং প্রতিদিনই তারা তাদের সেই খেলায় কোন না কোন নতুনত্ব যোগ করে।
বাচ্চারা সাধারণত জন্মের পর থেকেই বিভিন্ন রকম খেলনা ও খেলার প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই রং, শব্দ ইত্যাদি আলাদা করতে শিখে। ইনফ্যান্টরা যেমন হাত ব্যবহার করে খেলনা কাছে আনতে শিখে। বাচ্চারা যখন বসতে এবং হামাগুড়ি দিতে শিখে, নিত্য নতুন জিনিসপত্রের পাশাপাশি আকর্ষণীয় রঙিন খেলনাই তাদের সামনে এগুতে, আনন্দ পেতে উৎসাহ যুগিয়ে থাকে।
খেলাধুলা কেন প্রয়োজন?
যদিও একটা বয়স পরে বাবা-মায়েরা সন্তানের খেলাধুলা খুব একটা পছন্দ করেন না। এমন কোন বাচ্চা নেই যে কিনা খেলার জন্যে বকুনি খায়নি। শিশু বয়সে খেলাধুলা সাপোর্ট করলেও বড় হবার সাথে সাথে সেগুলো যেন কমতে থাকে। কিন্তু বিজ্ঞান বলে ভিন্ন কথা। বরং বাচ্চাদের নিয়মিত বিভিন্ন খেলার সাথে সম্পৃক্ত থাকতেই বিজ্ঞান প্যারেন্টসদের উৎসাহিত করে। শিশুর পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশে খেলা কেন প্রয়োজন? আসুন জেনে নেই বিষয়গুলো –
ইমোশনাল ডেভেলপমেন্ট
খেলনা বাচ্চাদের সৃজনশীলতা বাড়ায় এবং তাদের আবেগ প্রকাশ করতে সহায়তা করে। খেলনার সাথে কথা বলে, বন্ধু বানিয়ে তাদের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করে থাকে। বাচ্চারা মা বাবার কাছ থেকে দেখে দেখে প্রতিদিনের ঘটনা গুলোই প্রিয় টেডিবিয়ারটির সাথে অনুকরণ করে। মায়ের দেখাদেখি তারা ডলের জন্য রান্না করে, বাবার মত ব্যাগ নিয়ে অফিস যায়, খেলনা থার্মোমিটার দিয়ে বোনের জ্বর চেক করে। এসব ছোট ছোট খেলা তাদের মানসিকতা তৈরি করে, ইমোশন প্রকাশ করতে হেল্প করে, এবং ইমোশনাল ইনটিলিজেন্স ডেভেলপ করে।
সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট
বাচ্চাদের ভাষা শিখার পাশাপাশি বাচ্চারা সামাজিক দক্ষতা গুলো ও শিখে ফেলে। খেয়াল করেছেন কি? কথা শেখার পড়ে বাচ্চারা খেলনার সাথেও কথা বলে। খেলনার সাথেই তাদের প্রথম বন্ধুত্বটা যেন গড়ে উঠে। পর্যায়ক্রমে সমবয়সী অন্য কোন বাচ্চার সাথে, প্রতিবেশীদের সাথেও কথা বলায় স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে উঠে। কথা বলা, মেলামেশা, তথ্য আদান প্রদানের মাধ্যমে তারা সকলের সাথে মানিয়ে নেয়ার দক্ষতা অর্জন করে ফেলে। অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলা করার সময় একসাথে খেলা, সাহায্য করা, এবং সম্মান করা, শেয়ার করা ইত্যাদি শিখে যায়।
আবার দেখবেন, বাচ্চারা কখনোই কোন কাজে হার মানে না। আমরা বড়রা হয়তো একটা কাজ ৫ বার চেষ্টা করার পরই আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। কিন্তু বাচ্চাদের সামনে আপনি একটা বক্স ২বার খুলে দেখান। আপনি ঢাকনা লাগিয়ে বন্ধ করে দিয়ে দেখুন। না খোলা পর্যন্ত তারা চেষ্টা করতেই থাকে।
পারিপাশ্বিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা লাভ
শিশু যখন পৃথিবীতে আসে সে তখন কিছুই জানে না, বুঝে না। সম্পূর্ণ নতুন একটা জগত থাকে তাদের সামনে। খেলনার মাধ্যমে, কথার মাধ্যমে শিশু শব্দ সম্পর্কে ধারণা পায়। তারপর নানা রঙের খেলনা দেখে রঙের ভিন্নতা, বিভিন্ন আকার বা শেপ/আকার বুঝতে শিখে, চিনতে শিখে।
ভাষা দক্ষতা উন্নয়ন
খেলতে খেলতে বাচ্চাদের ভাষা দক্ষতা বিকশিত হয়। আপনি খেয়াল করলে দেখবেন বাচ্চারা খেলার সময় তার খেলনার সাথে কথা বলে। আবার আপনার লিটল এঞ্জেল যদি একা খেলা করে তাহলে আপনাকে ও সাথে নিতে চায়। রান্নাবাটি খেলার সময় রান্না করে এসে বলে মা খেয়ে দেখতো কেমন হয়েছে। এভাবে খেলতে খেলতেই ২-৩ বছরের মধ্যেই তারা মাতৃভাষা টা শিখে নেয়। এখানে বাচ্চার সামনে আপনি যে ভাষায় কথা বলবেন সে ভাষাই শিখবে। মাতৃভাষা বাংলা কিন্তু শিশুর বাবা মা যদি ওর সামনে ইংরেজিতে কথা বলে, দেখবেন আস্তে আস্তে সে ও রেসপন্স করছে।
ফিজিক্যাল এক্টিভিটি
খেলনা বাচ্চাদের বিভিন্ন ফিজিক্যাল এক্টিভিটিতে সারাদিন ব্যস্ত রাখে। যেমন, লুকোচুরি খেলার সময় বাচ্চারা দৌড়ে দৌড়ে লুকায়, খুঁজে বের করে। ফুটবল খেলার সময় সবাই মিলে দৌড়ে খেলে। এতে করে খাবার হজম ভাল হয়, শরীর ক্লান্ত হয়, বাচ্চারা ভাল ঘুমায় যা বাচ্চার গ্রোথে ভূমিকা রাখে।
লাইফ স্কিল
বাচ্চারা তার প্রিয় ডলটাকে খাইয়ে দেয়, গোসল করায়, জামা চেঞ্জ করে নতুন জামা পরায়। এতে খেলায় খেলায় বাচ্চারাও এই লাইফ স্কিলগুলো শিখে নেয়। তারা একসময় নিজের হাতে খেতে চায়, গোসলের সময় নিজেই মাথায় পানি ঢালতে চায়। এভাবে তারা নিজের কাজগুলো নিজেই করতে শিখে যায়।
অভিভাবক হিসেবে আপনার মনে হতে পারে খেলা কিংবা খেলনা কেবল আনন্দ এবং মজার একটা উপাদান মাত্র। কিন্তু খেলনা লার্নিং এর অন্যতম একটা টুলও বটে। শিশুদের কাছে খেলনা তার সঙ্গী, সেরা বন্ধু, শিক্ষক, যা তাদেরকে কনফিউজিং পৃথিবীতে গাইড করে, নিজেকে বুঝতে সহায়তা করে।